ফিলিপ গাইন | News Link
শুক্রবার, মে ১, ২০২০ ০৯:২০ অপরাহ্ন | ২০১০ সালে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বেদিতে চা-শ্রমিকদের প্রতিবাদ সভা। ছবি: ফিলিপ গাইন
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশব্যাপী চলমান লকডাউনের শুরুর দিকে এক বা দুই দিনের জন্য কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন সিলেট বিভাগের প্রায় ৬০টি চা-বাগানের শ্রমিকরা। মালিকরা বাগানের কার্যক্রম বন্ধ করতে না চাইলেও তারা সেটি অগ্রাহ্য করেন। বাগান মালিকরা আত্মতৃপ্তির সঙ্গে দাবি করেন, চা-শ্রমিকদের আবাসস্থল ও কর্মস্থল নিরাপদ। তাই তাদের করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি নেই।
বিদ্রোহী শ্রমিকরা মালিকদের সঙ্গে তখন একমত পোষণ করেননি। তাদের প্রশ্ন ছিল, যদি গার্মেন্টস শ্রমিকদের বন্ধ দেওয়া হয়, তবে তাদের কেন দেওয়া হবে না? পরে সরকার ও মালিকদের কাছে চা-বাগান লকডাউনের আওতায় আনা ও চা-শ্রমিকদের পুরো বেতনসহ ছুটি দেওয়ার দাবি জানিয়ে চিঠি লেখা শুরু করে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার চা-শ্রমিকের সংগঠন বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন।
চা-শ্রমিকরা যখন বিভ্রান্ত ও অস্থির হয়ে উঠছিলেন, ঠিক সেই সময়ে গত ৩১ মার্চ জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘চা-শ্রমিকরা পাতা সংগ্রহের সময় বিচ্ছিন্নভাবে থাকে। …. এবং যেহেতু তারা প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকেন, তাই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ফলে চা-বাগানের কার্যক্রম চলমান থাকতে পারে।’
‘চা-পাতা জমা করার সময় শ্রমিকরা যদি দূরে দূরে থাকে, তবে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয় এবং যেহেতু সেখানে কেউ আক্রান্ত হয়নি, তাই চিন্তার কোনো কারণ নেই।’
সিলেটের জেলা প্রশাসকের মতামত শুনেই প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। চা-বাগান মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) মতামত এবং জেলা প্রশাসক ও প্রধানমন্ত্রীর মতামত একই।
চা-শ্রমিক ও তাদের ইউনিয়ন প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ১ এপ্রিল থেকে তারা আবার কাজে ফিরে যায় এবং তখন থেকে সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করে যাচ্ছেন।
এখন গার্মেন্টস ও সরকারি অফিস আবার চালু হচ্ছে। কাজেই সর্বশেষ ২০ এপ্রিল চা-বাগান লকডাউন করে শ্রমিকদের মজুরিসহ ছুটি দেওয়ার যে অনুরোধ বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন করেছে, মালিকরা সেটা শুনবে— এমন আশা করা যায় না।
মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে কার্যত বিপর্যয় নেমে এসেছে। এই সময়ে চা-শ্রমিকরা, যাদের ৯০ শতাংশই বাঙালি নন, তারা মালিকদের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করেছেন।
১৮৩৯ সালে যখন ভারতে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়, তখন থেকেই চা-শ্রমিকদের সিংহভাগকে অন্য জায়গা থেকে নিয়ে আসা হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ‘কুলি’ বলে পরিচিত এসব শ্রমিকরা দাসত্বের জীবন যাপন করতেন। তাদের অনেকেই ভারতের কুলি-ধরা আরকাঠি, সিরদার ও মাইস্ত্রী এবং শ্রীলংকার কাঙ্গানিদের হাতে আটকা পড়ে চা-বাগানে আসেন।
চা-শ্রমিক ও তাদের পূর্ব পুরুষেরা দুইটি মহাযুদ্ধ, নানা রকমের মহামারি ও স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বিভিন্ন দুর্যোগের মধ্য দিয়ে গেছেন। এসব কিছুর তারা নীরব শিকার। কারণ, তারা শেকড়ছিন্ন ও মালিকদের ওপর নির্ভরশীল।
তারাও স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক এবং দেশের যেকোনো স্থানে বাস করার অধিকার তাদেরও রয়েছে। কিন্তু, যে অবস্থার মধ্যে তারা আটকে গেছে, তাতে চা-বাগানেই তাদের জীবন পাড় করতে হচ্ছে। সেখানে তাদের নেই নিজস্ব কোনো জমি বা বাড়ি। প্রান্তে বেঁচে থাকা এসব মানুষ তাই জীবনভর বাগান মালিক ও রাষ্ট্রের ইচ্ছার কাছেই নতি স্বীকার করে আসছেন।
অসহায় চা-শ্রমিক ও দুর্ভাগা ট্রেড ইউনিয়ন
করোনা মহামারিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চা-শ্রমিকদের জীবনে সামান্যই পরিবর্তন এসেছে। এখন আর তাদের ‘কুলি’ বলে ডাকা হয় না। তবে, ব্রিটিশ-ভারতীয় আমলের চেয়ে তারা এখন যে খুব ভালো জীবন যাপন করছে, তা কিন্তু নয়। দেশের অন্যান্য নাগরিকরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন, তারা সেগুলো পান না।
চা-শ্রমিকদের বিচ্ছিন্নভাবে বাস করতে হবে, তাই তারা নিরাপদ! যে কারণে মালিকরা তাদের সঙ্গে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে এবং রাষ্ট্র ও আইনপ্রণেতারাও তাদের (মালিকদের) স্বার্থই রক্ষা করে। এমন সব অভিযোগের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণাদি আছে কি? নিশ্চয়ই, অনেক প্রমাণ আছে।
এর মধ্যে অন্যতম— বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬’এ ইউনিয়ন করার ব্যাপারে চা-শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য। শ্রম আইন কোনো প্রতিষ্ঠানপুঞ্জের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র জাতীয় পর্যায়ে ইউনিয়ন করার অধিকার দিয়েছে। সব চা-বাগান একটি প্রতিষ্ঠানপুঞ্জ হিসেবে পরিগণিত।
কাজেই চা-শ্রমিকরা কেবল জাতীয় পর্যায়ে ইউনিয়ন করতে পারেন এবং একটি ইউনিয়ন করার জন্য মোট শ্রমিকের অন্তত ২০ শতাংশ ও সব প্রতিষ্ঠানের ২০ শতাংশকে সদস্য হতে হবে! মালিক ও সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে ইউনিয়ন করার জটিলতা এমনই যে চা-শিল্পে দ্বিতীয় কোনো ইউনিয়ন করা একেবারেই অসম্ভব এবং এর ফলাফল যে সুদূরপ্রসারী, তা সহজেই অনুমেয়।
অন্যান্য শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের ১০ দিনের নৈমিত্তিক ছুটি থাকলেও চা-শ্রমিকদের নেই। অন্যান্য শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা যেখানে ১৮ দিন কাজ করে এক দিনের অর্জিত ছুটি পান, সেখানে চা-শ্রমিকরা পান ২২ দিন কাজ করে।
আমরা যদি চা-বাগানে শ্রম আইন ও শ্রম বিধিমালা লঙ্ঘন দেখি, তাহলে তালিকা আরও দীর্ঘ। প্রথমত— চা-শ্রমিকদের কোনোই নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। শ্রম আইনে বলা আছে, ‘কোনো মালিক নিয়োগপত্র প্রদান না করিয়া কোনো শ্রমিককে নিয়োগ করিতে পারিবেন না এবং নিয়োজিত প্রত্যেক শ্রমিককে ছবিসহ পরিচয়পত্র প্রদান করিতে হইবে।’ কিন্তু, চা-বাগানের কোনো শ্রমিকই মালিক পক্ষের কাছ থেকে নিয়োগপত্র পাননি।
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা তপন দত্ত বলেন, ‘চা-বাগানের মালিকরা প্রভিডেন্ট ফান্ডের কাগজপত্রকেই নিয়োগপত্র হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।’
এমন বহু অভিযোগ রয়েছে যে, কোনো শ্রমিককে স্থায়ী করার আগে কয়েক বছর অস্থায়ী হিসেবে কাজ করানো হয়। অস্থায়ী হিসেবে কাজ করা শ্রমিকরা রেশন, চিকিৎসাসেবা ও বেতনসহ ছুটি পান না।
আরেকটি বড় উদ্বেগের বিষয় হলো— শ্রমিকরা কোনো গ্র্যাচুইটি পান না। ভেবে দেখুন, একজন চা-শ্রমিক সারাজীবন বাগানে কাজ করে গেলেন, অথচ কর্মজীবনের শেষে কোনো গ্র্যাচুইটি পেলেন না। গ্র্যাচুইটি দেওয়ার ক্ষেত্রে মালিকরা শ্রমিকদের ব্ল্যাকমেইল করে— এমন অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায়।
বাংলাদেশ শ্রম আইনের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো শ্রমিকের চাকরির অবসান হইলে, তাহা যেকোনো প্রকারেই হোক না কেন, তিনি তাহার চাকরির অবসানের ৬০ দিনের মধ্যে মালিক কর্তৃক তাহাকে বরাদ্দকৃত বাসস্থান ছাড়িয়া দিবেন৷’
চা-শ্রমিকরা বাগানের সঙ্গে বাঁধা। বাঙালি নন, এমন শ্রমিকদের প্রায় শতভাগেরই বাগানের ভেতরে বা বাইরে নিজস্ব কোনো জমি বা সম্পদ নেই। কাজেই চাকরিচ্যুত হওয়ার পর বা কর্মজীবনের শেষে তাদের আবাসস্থল যদি ছেড়ে দিতে হয়, তাহলে তারা কোথায় যাবে?
সাধারণত, পরিবারের এক সদস্য অবসরে গেলে আরেক সদস্য তার জায়গায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু, যদি তাদের কেউ গ্র্যাচুইটি দাবি করেন, তাহলে তারা বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে পারেন।
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বলেন, ‘২০১৮ ও ২০১৯ সালের জন্য বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন ও মালিকদের সংগঠনের সঙ্গে সর্বশেষ যে চুক্তি হয়েছে, তাতে গ্র্যাচুইটি দেওয়া মালিকের জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু, অবসরে যাওয়া কোনো শ্রমিকই এখনো গ্র্যাচুইটি পাননি।’
চা-শ্রমিকদের গত ১৫০ বছরের ইতিহাস এমনই যে বাংলাদেশ শ্রম আইনের ৩২ নম্বর ধারা তাদের ওপরে প্রয়োগ না করার যে দাবি, তার পেছনেও যুক্তি আছে।
এ ছাড়াও, চা-শ্রমিকরা দাবি করেন, তারা যে ঘরে থাকেন ও যে জমি ব্যবহার করেন, রাষ্ট্র ও মালিকরা তার মালিকানা তাদের দিয়ে দেক।
২০০৬ সালের শ্রম আইন (অনুচ্ছেদ ২৩৪) অনুযায়ী, কোম্পানির মুনাফার পাঁচ শতাংশ শ্রমিকদের পাওয়ার কথা। মুনাফার এই অর্থ শ্রমিকদের অংশগ্রহণমূলক তহবিল ও শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে জমা দেওয়ার কথা। যা তারা সম্মিলিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারবেন।
বর্তমান শ্রম আইন প্রণয়নের আগেই চা-বাগানে এই বিধান ছিল। তবে, চা-শ্রমিকরা অতীতেও এই লভ্যাংশ পাওয়া থেকে বঞ্চিত ছিলেন, এখনো আছেন।
শ্রম আইন ও ২০১৫ সালের শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী, শ্রমিকদের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য সুবিধা দেওয়ার কথা থাকলেও সেগুলো থেকে বঞ্চিত চা-শ্রমিকরা। যেমন: কর্মস্থলে টয়লেট ও প্রক্ষালন সুবিধা। যেখানে চা-শ্রমিকরা চা-পাতা তোলার কাজ করেন এবং যেখানে চা-পাতা তোলা শ্রমিকদের ৯০ শতাংশই নারী, সেখানে না আছে টয়লেট, না আছে প্রক্ষালন কক্ষ। তা ছাড়া, খাবার পানির সরবরাহও সবসময় পর্যাপ্ত থাকে না— এমন অভিযোগও আছে।
যদি বাগান মালিকরা শ্রম বিধিমালা (অনুচ্ছেদ ৭৯) অনুসরণ করেন, তাহলে বাগানের ৫০০ বা তার অধিক শ্রমিকদের জন্য একজন কল্যাণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার কথা। যদি শ্রমিকের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি হয়, তাহলে প্রত্যেক দুই হাজার শ্রমিকের জন্য একজন অতিরিক্ত কল্যাণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার কথা। এসব কল্যাণ কর্মকর্তারা বাগানের মালিক ও শ্রমিক— উভয়ের কল্যাণে কাজ করবেন।
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বলেন, ‘আমরা এখনো দেখিনি বা শুনিনি কোনো কল্যাণ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটি একটি প্রহসন।’
আইন অনুযায়ী, শ্রমিক ও তাদের পরিবার, বিশেষ করে পরিবারের শিশুদের প্রতি আরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে চা-বাগান মালিকদের। তবে, মালিকরা সেগুলো এড়িয়েই চলেন।
চা-বাগানে শ্রম আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার দায়িত্ব শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই)। কিন্তু, অভিযোগ আছে— সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটিই শ্রম আইন ও শ্রমমান লঙ্ঘনের নীরব সাক্ষী।
দেশে লকডাউন চলাকালীন যখন চা-শ্রমিকদের নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও কাজ করতে বাধ্য করা হয়, তখন বাগান মালিকদের ক্ষমতা ও প্রভাবের বিষয়টি সুস্পষ্ট। অসহায় শ্রমিকরাই মালিকদের প্রতি অনুগ্রহ করছেন।
এক্ষেত্রে, সরকারের দায়িত্ব কী? এখনই সময়, সরকারের উচিত চা-বাগানে শ্রম আইন ও বিধিমালা পুরোপুরি কার্যকর করতে মালিকদের বাধ্য করা। যাতে চা-শ্রমিকদের আর বৈষম্যের শিকার হতে না হয় এবং তারা কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি পান।
ফিলিপ গাইন: গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (শেড) পরিচালক
philip.gain@gmail.com
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)