আগস্টের ৯-২৭ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চা-বাগানগুলোয় শ্রমিকরা দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে নজিরবিহীন ধর্মঘট পালন করেন। ধর্মঘটের এক পর্যায়ে বাগান মালিক পক্ষ দৈনিক নগদ ১৪৫ টাকা মজুরি দিতে সম্মত হয়। এতে শ্রমিক অসন্তোষ আরও বেড়ে যায়।
শ্রমিকরা মালিকদের সিদ্ধান্ত, বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা ও সংস্থা (জেলা প্রশাসক, শ্রম অধিদপ্তর ও পুলিশ) এবং তাদের নেতাদের সিদ্ধান্ত, আদেশ ও অনুরোধ উপেক্ষা করে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত রাখেন।
চা-বাগানের শ্রমিকরা ২৪ আগস্ট মৌলভীবাজার-বড়লেখা আঞ্চলিক মহাসড়ক কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেন। ওইদিন মৌলভীবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য ও পরিবেশমন্ত্রী সেখানে গিয়ে শ্রমিকদেরকে আশ্বস্ত করেন যে শিগগির তাদের মজুরির বিষয় সমাধান করা হবে।
দৈনিক ৩০০ টাকার মজুরির দাবি পূরণ না হলে শ্রমিকরা কাজে ফিরবেন না এমন শক্ত অবস্থানের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আপনাদের সঙ্গে শিগগির কথা বলবেন। মজুরির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন। আগামী ৩ দিনের মধ্যে মজুরি সমস্যার সমাধান হবে।’
গত ২৪ আগস্ট থেকে ৩ দিনের মাথায় ২৭ আগস্ট চা-বাগান মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) প্রতিনিধিদের সঙ্গে ২ ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী চা-শ্রমিকের দৈনিক নগদ মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণ করে দেন।
চা-শ্রমিকরা মজুরি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছিলেন এবং তার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে কাজে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।
চা-শ্রমিকরা তাদের দাবির তুলনায় অনেক কম মজুরি পেলেন বটে। তবে একবারে ৫০ টাকা মজুরি বৃদ্ধি আগে কখনো ঘটেনি। বিটিএ ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন (বিসিএসইউ) ২০১৯ ও ২০২০ সালের জন্য কার্যকর মজুরি নির্ধারণ করে যে চুক্তিপত্র সই করে তাতে দৈনিক মজুরি বেড়েছিল ১৮ টাকা। ওই সময় পর্যন্ত ওটাই ছিল সর্বোচ্চ মজুরি বৃদ্ধি।
ভবিষ্যতে মজুরি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে এবং তারা ন্যায্য মজুরি পাবেন—এমন আশা নিয়ে শ্রমিকরা কাজে ফিরে গেছেন। চা-শ্রমিকদের ইউনিয়ন ও মালিকপক্ষসহ সব পক্ষ এখন একে অপরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের সময় পেল।
তবে ৯-২৭ আগস্ট চা-শ্রমিকরা যে সর্বাত্মক ধর্মঘট চালিয়েছেন তা যেন আবার না ঘটে তার জন্য অনেক বিষয় আছে যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন। বুঝতে হবে কেন মজুরি বোর্ড ও মালিক-শ্রমিকপক্ষের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হওয়ার পর শ্রম আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ অবধারিত হয়ে পড়ে।
শ্রম আইনের ১৪০ক ধারায় সরকারকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা বলেই প্রধানমন্ত্রী সমাধানের কেন্দ্রে এসেছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
শ্রম আইনে এ ধারায় আছে, ‘এই আইনের ধারা ১৩৯, ১৪০ ও ১৪২ এ যে বিধানই থাকুক না কেন, বিশেষ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় সরকার কোন শিল্প সেক্টরের জন্য ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের যেকোনো পর্যায়ে নতুনভাবে ন্যূনতম মজুরি কাঠামো ঘোষণার জন্য ন্যূনতম মজুরি বোর্ড পুনর্গঠন এবং প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা প্রতিপালন সাপেক্ষে পুনরায় ন্যূনতম মজুরি হার ঘোষণা করিতে পারিবে। তবে শর্ত থাকে যে, এইরূপ ক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজন মনে করিলে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, নতুনভাবে ন্যূনতম মজুরি হার ঘোষণা না করিয়া শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সহিত আলোচনাক্রমে চলমান মজুরি হারের কোন সংশোধন বা পরিবর্তন কার্যকর করিতে পারিবে।’
তবে শ্রম আইন মেনে প্লাকিং বোনাস (নিরিখের অধিক তোলা পাতার জন্য প্রদত্ত অর্থ), মাঠে ও কারখানায় বেশি সময় কাজের জন্য প্রদত্ত অর্থ ও অন্যান্য সুবিধা বিবেচনায় নিয়েই মজুরির হিসাব করতে হবে।
মালিকদের মজুরির হিসাবে নগদ মজুরির বাইরে আরও যেসব সুবিধাকে অর্থে রূপান্তর করে মজুরির সঙ্গে যোগ করা হয়েছে সেসবের অধিকাংশকে শ্রম আইনের ২ ধারার ৪৫ উপধারা অনুসারে মজুরির অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।
গত ৩০ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে বিটিএর পক্ষ থেকে যে লিখিত বক্তব্য দেওয়া হয় তাতে বলা হয়েছে, মজুরি বৃদ্ধির পর একজন শ্রমিককে মালিক যা দিবে তা ‘গড়ে দৈনিক প্রায় ৫৪০ টাকা হয়’। এ হিসাব একেবারেই অযৌক্তিক!
নগদ মজুরির বাইরে অন্যান্য সুবিধার আর্থিক মূল্য নির্ধারণের জন্য বিটিএ, বিসিএসইউ এবং অন্য যারা জড়িত তারা ভারতের আসামে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য মজুরির হিসাব দেখতে পারে।
আসামে গত ১ আগস্ট থেকে কার্যকর দৈনিক নগদ মজুরি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাগানগুলোর জন্য ২৩২ রুপি ও বরাক উপত্যকার জন্য ২১০ রুপি নির্ধারণ করা হয়েছে।
দৈনিক নগদ মজুরির বাইরে আসামে একজন শ্রমিক যেসব ইন-কাইন্ড সুবিধা ও ক্ষতিপূরণমূলক সুবিধা (কনপেনসেন্টরি বেনিফিট) পান তার পরিমাণ ১০৪ রুপি।
আসামের লেবার ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টের নোটিফিকেশনে প্রকাশ করা হয়েছে এ হিসাব। নগদ মজুরির বাইরে যুক্ত এসব খাত হলো: রেশন (১৪ দশমিক ২০ রুপি), চিকিৎসা সুবিধা (১৬ দশমিক ৭৫ রুপি), আবাসন সুবিধা (১৫ দশমিক ২২ রুপি), জ্বালানি কাঠ (৫ দশমিক ৭৪ রুপি), কল্যাণ কর্মসূচি (৫ দশমিক ৬০ রুপি), শিক্ষা সুবিধা (২ দশমিক ৮৫ রুপি) ও চা (৩ দশমিক ৬৬ রুপি)।
দৈনিক ক্ষতিপূরণমূলক সুবিধার (কনপেনসেন্টরি বেনিফিট) মধ্যে আছে এক্স-গ্রাসিয়া (২৫ দশমিক ০৩ রুপি) ও মজুরিসহ ছুটি এবং উৎসব ভাতা (১৪ দশমিক ৯৫ রুপি)। অর্থাৎ তাদের দৈনিক যৌগিক (কম্পোজিট) মজুরি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার জন্য ৩৩৬ রুপি ও বরাক উপত্যকার জন্য ৩১৪ রুপি।
আসামের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করছি কারণ আসাম ও বাংলাদেশের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। আসাম ও বাংলাদেশে উৎপাদিত চায়ের দাম প্রায় সমান।
বাংলাদেশের বিটিএ নগদ ও অন্যান্য সুবিধা মিলিয়ে মজুরির যে হিসাব দিয়েছে তা সবাইকে বিস্মিত করেছে। বিটিএর তথ্য অনুসারে চা-শ্রমিকদের ৯০ শতাংশ কাজ করেন মাঠে এবং ১০ শতাংশ কারখানায়। মাঠে চা-শ্রমিকরা চা গাছ লাগান, সেগুলোকে বড় করেন, যত্ন নেন এবং নারী শ্রমিকরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রতিদিন দীর্ঘসময় ধরে চায়ের কচি পাতা তোলেন। সবুজ পাতা তোলার দৃশ্যই আমরা বেশি দেখি যা আমাদেরকে মুগ্ধ করে।
‘মালিকপক্ষ নগদ মজুরির ওপরে প্রদত্ত অন্যান্য সুবিধার যে আর্থিক মূল্য হিসাবে এনেছে তা আমি প্রত্যাখ্যান করি,’ বলেন বিসিএসইউর নির্বাহী উপদেষ্টা ও মজুরি বোর্ডে চা-শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সদস্য রামভজন কৈরি। তার পরামর্শ মালিক পক্ষকে শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে নগদ মজুরির বাইরে আর যা কিছু দিচ্ছে তার আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে।
‘মালিকপক্ষ এ পর্যন্ত যা করেছে তা তাদের ইচ্ছামত’ দাবি কৈরির। তিনি বলেন, ‘আসামে প্লাকিং বোনাস ও অধিকাল কাজের অর্থ মজুরির অন্তর্ভুক্ত নয়।’
মালিকপক্ষ কীভাবে ইচ্ছা মতো হিসাব করে তার উদাহরণ দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘তাদের হিসাবে একজন শ্রমিক মাসে ভর্তুকি মূল্যে ৪২ (২ টাকা কেজি দরে) আটা বা চাল পান। আমাদের হিসাবে একজন শ্রমিক মাসে বড়জোর ২০ কেজি চাল বা আটা পান।’
শ্রমিকদের নিয়ে কর্মরত সলিডারিটি সেন্টারের কান্ট্রি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর এডভোকেট নাসিম রামভজন কৈরির সমর্থনে বলেন, ‘শ্রমিকরা দৈনিক নগদ যা পান (১২০ টাকার সময়) তার সঙ্গে মালিক পক্ষ অন্যান্য সুবিধার ও সেবার আর্থিক মূল্য ইচ্ছা মতো যোগ করে বিভ্রান্তিকর হিসাব দিয়েছে। অন্যান্য সুবিধার সঙ্গে প্লাকিং বোনাস, উৎসবভাতা, চিকিৎসা ও বার্ষিক ছুটি ভাতা ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রশাসনিক ব্যয় মজুরির সঙ্গে যোগ করে মালিকপক্ষ আমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছে।’
তার মতে, ‘শ্রম আইন মানলে মালিকরা এসব “মূল মজুরি”র মধ্যে যোগ করতে পারে না।’
শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েছেন এবং তারা এখন ১৭০ টাকা দৈনিক নগদ মজুরি পাবেন, যা ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ১২০ টাকা। অর্থাৎ নতুন মজুরি কাঠামো ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। তখন থেকে এ পর্যন্ত (আগস্ট ২০২২) ২০ মাস যে শ্রমিক পুরো সময় কাজ করেছেন তিনি সরলীকৃত হিসাবে (৫০ টাকা X ৩০ দিন X ২০ মাস) বকেয়া হিসাবে পাবেন ৩০ হাজার টাকা।
বিটিএ ও বিসিএসইউকে এখন জানুয়ারি ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২২ সালের জন্য কার্যকর কর্মোত্তর (পোস্ট-ফ্যাক্টুম) চুক্তি সই করতে হবে এবং কয়েক দফায় শ্রমিকের বকেয়া শোধ করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে এমনটাই হয়ে এসেছে।
বকেয়া পাওয়ার প্রশ্নে উদ্বেগের বিষয় হলো চা-বাগানগুলোয় এক লাখের মতো স্থায়ী শ্রমিকের পাশাপাশি ৪০ হাজারের মতো অস্থায়ী শ্রমিক বকেয়া পাবেন কি না। গত ২ বার চুক্তির সময়কালে (৪ বছর) অস্থায়ী (ক্যাজুয়াল) শ্রমিকরা স্থায়ী শ্রমিকদের সমান মজুরি পেয়ে আসছেন। তবে স্থায়ী শ্রমিকরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পান তা তারা পান না।
রামভজন কৈরি বলেন, ‘সময়মতো যদি মালিক-শ্রমিকের চুক্তিপত্র সই হতো তাহলে অস্থায়ী শ্রমিকরা প্রথম থেকেই বর্ধিত হারে মজুরি পেতেন। কাজেই অস্থায়ী চা-শ্রমিকদেরকে বকেয়া দেওয়ার প্রথা এখনই শুরু করা দরকার।’
গত আগস্টে আমরা যা দেখলাম তা চা-বাগানে প্রতিবাদের নতুন অধ্যায় সূচনা করল। চা-শ্রমিকরা, বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা, তাদের সম্মিলিত শক্তি প্রদর্শন করেছেন। মজুরির ব্যাপারে মূল দাবির আংশিক পূরণ হলেও তারা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে কাজে ফিরে গেছেন। এরপরও যা ঘটেছে তাকে চা-শ্রমিকদের নীরব বিদ্রোহেরই বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
স্মরণে রাখতে হবে যে চা-শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজন ৫ প্রজন্ম ধরে চা-বাগানে আটকে আছেন। তারা যে জমিতে বাস করেন এবং যে জমিতে তারা কাজ করেন ও চাষ করেন সে জমির মালিক তারা নন। তারা যে ঘরে বাস করেন, সে ঘরেরও মালিক তারা নন। কাজেই মজুরি ছাড়াও তারা আরও গুরুতর বিষয় তুলতে পারেন, আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন।
আমরা আশা করব, বর্তমান ২ বছরের চুক্তির মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার পর অতীতের মতো ভবিষ্যতে বিটিএ ও বিসিএসইউর মধ্যে দরকষাকষি আটকে থাকবে না। সময় মতো চুক্তি সম্পাদন ও যুক্তিসঙ্গত মজুরি নির্ধারণই চা-বাগানে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করবে।
ফিলিপ গাইন: গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভলপমেন্টের পরিচালক।