ফিলিপ গাইন | News Link
ভারতের আসামে বাণিজ্যিক চা চাষ শুরু হয় ১৮৩৯ সালে। বর্তমান সিলেট অঞ্চল তখন আসামের মধ্যে। আর তখনকার আসাম ও এখনকার বাংলাদেশে বাণিজ্যিক চা চাষের সূচনা ১৮৫৪ সালে। বর্তমানে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বড় বড় চা বাগানের সংখ্যা ১৫৮টি। এসব চা বাগান ১ লাখ ১২ হাজার ৭৪৫ দশমিক ১৫ হেক্টর জমিজুড়ে। এক সময় এসব চা বাগান এলাকা ছিল জঙ্গল এবং তাতে ছিল সর্বসাধারণের অধিকার। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা বসভূমির ওপর তাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে। আর ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে এসব জমির মালিকানা চলে আসে রাষ্ট্রের হাতে। অর্থাৎ ঐতিহ্যবাহী চা বাগানের জমির মালিক রাষ্ট্র। প্রতিটি বাগানের মালিককে চা চাষের জমির ইজারা নিতে হয় রাষ্ট্রের কাছ থেকে। এসব ঐতিহ্যবাহী চা বাগানের বাইরে সাম্প্রতিক সময়ে পঞ্চগড়ে সাতটি ও ঠাকুরগাঁওয়ে একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া উত্তরবঙ্গে ছোট ছোট চা চাষের খামার আছে ৫ হাজার ৩৫১টি।
এসব বাগানে কাজ করেন ১ লাখ ৪০ হাজার ১৮৪ জন শ্রমিক। এদের মধ্যে উত্তরবঙ্গের ১ হাজার ৮১৮ শ্রমিক বাদে বাকি সবাই কাজ করেন ঐতিহ্যবাহী ১৫৮টি চা বাগানে। এসব শ্রমিকের মধ্যে নিবন্ধিত শ্রমিক ১ লাখ ৩ হাজার ৭৪৭ জন এবং অনিবন্ধিত ৩৬ হাজার ৪৩৭ জন। উভয় প্রকার শ্রমিকের মধ্যে পুরুষ ৬৯ হাজার ৪১৫ এবং নারী ৭০ হাজার ৭৬৯ অর্থাৎ নারী শ্রমিকের সংখ্যা পুরুষ শ্রমিক থেকে ১ হাজার ৩৫৪ জন বেশি। এ হিসাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অধীন বাংলাদেশ চা বোর্ডের।
চা বাগানে শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে যে পাঁচ লাখের মতো মানুষ তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশের অধিক অবাঙালি। এদের জাতি পরিচয় অবাক করার মতো। সাম্প্রতিক সময়ে চা শ্রমিক হিসেবে যোগ দেয়া বাঙালি ৫ শতাংশের মতো আর বিহারি মুসলমান ৩ শতাংশের মতো। বাকিদের মধ্যে আছেন আদিবাসী ও নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টে (সেড) ২০১৪-১৬ সালে পরিচালিত জরিপ ফলাফল অনুসারে চা বাগানে ৮০টির মতো জাতিগোষ্ঠী আছে এবং তাদের মধ্যে প্রচলিত আছে ১৩টি ভাষা। তবে চা বাগানের শ্রমিক পরিবারগুলোর মধ্যে হিন্দু ধর্মবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
ব্রিটিশ আমলে চা বাগান শুরু করতে গিয়ে আসাম বা বর্তমান বাংলাদেশের যেখানে চা বাগান, সেখানকার মানুষদের চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য পাওয়া যায়নি। আসামের স্থানীয় মানুষ ও বাঙালিরা জঙ্গল কেটে, মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে চা বাগানে কাজ করার জন্য মানসিকভাবে তৈরি ছিল না। তখন চা বাগানে কাজ করার জন্য আড়কাটি, মাইস্ত্রি এবং সরদার বলে পরিচিত দালাল শ্রেণীর লোকদের লাগানো হলো শ্রমিক সংগ্রহের কাজে। তারা বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিম বঙ্গ ও উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রমিক সংগ্রহের কাজে লেগে গেল। যাদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে চা বাগানে কাজ করার জন্য আকৃষ্ট করা হলো, তারা মূলত হিন্দুদের চার বর্ণের বাইরে পঞ্চম শ্রেণীর মানুষ ও আদিবাসী। ভারতবর্ষে এরা অস্পৃশ্য, দলিত, হরিজন, ট্রাইবাল এসব শব্দ দ্বারা পরিচিত। তারা যখন পরিবার-পরিজন নিয়ে দলে দলে চা বাগানগুলোতে এল, তখন তারা বুঝতে পারল তাদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু ইংরেজ সাহেবরা এবং তাদের সহযোগিরা এদের নানা কৌশলে চা বাগানে আটকে দিল।
আজকে আমরা যেসব সুদৃশ্য চা বাগান দেখি তা সে সময় ছিল বাঘ, ভাল্লুক, বিষধর সাপ, মশা ও জোঁকসহ নানা বন্য প্রাণীতে পরিপূর্ণ। বিপুলসংখ্যক শ্রমিক মারা গেল জঙ্গল পরিষ্কার করে বাগান তৈরি করতে। তারা ব্রিটিশ সাহেবদের জন্য ও তাদের ম্যানেজারদের জন্য তৈরি করল সুদৃশ্য সব বাংলো। কিন্তু তাদের নিজের ঠাঁই হলো শ্রমিক কলোনির মাটির ঘরে। সেখানে তাদের পরিবার-পরিজনের একটা বড় অংশ ডায়েরিয়া, কলেরা, গুটিবসন্তসহ নানা রোগ-শোকে মারা পড়ল। আজ আমরা যখন চা বাগানগুলোয় যাই, একই দৃশ্য দেখি। চা বাগানের ম্যানেজাররা বাস করেন সুদৃশ্য ও বিশালবহুল বাংলোয়। একজন ম্যানেজারের দেখাশোনার জন্য কুড়িজন পর্যন্ত নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন। আর শ্রমিকরা বাস করেন লেবার লাইন বা শ্রমিক কলোনিতে, যেখানে অধিকাংশ ঘর কাঁচা ও নিম্নমানের।
চা বাগানে যে শ্রমিক বিরতিহীনভাবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন, চা উৎপাদনের জন্য তারাই বাঁচিয়ে রেখেছেন চা শিল্পকে। ব্রিটিশ আমলে তাদের বলা হতো ‘কুলি’। বর্তমানেও তারা অনেকটাই অস্পৃশ্য হিসেবে বিবেচিত। তার পরও বাগানের ম্যানেজার ও মালিক তাদের কাছে ‘মা-বাপ’।
কিন্তু চা শ্রমিকরা যে এত শ্রম দিয়ে মালিক-ম্যানেজারকে বিলাসবহুল জীবনযাপনের সুযোগ করে দিয়েছেন, তার বিনিময়ে তারা কী পাচ্ছেন? আজকে দেশব্যাপী মানুষ মনের আনন্দে চা পান করে। কিন্তু চা শিল্পকে বাঙালি নয় এসব শ্রমিক চাঙ্গা করে রেখেছেন। বিনিময়ে তারা কী পাচ্ছেন?
সর্বশেষ একটি ঘটনার কথা বলি। ৪ জুন প্রথমবারের মতো পালিত হলো জাতীয় চা দিবস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চা বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৫৭ সালের ৪ জুন হতে ১৯৫৮ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত। তার সম্মানেই জাতীয় এ দিবসের সূচনা। এটি অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার বিশেষ করে চা শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের জন্য। চা শিল্পে লাখের অধিক নিবন্ধিত শ্রমিকের একমাত্র ট্রেড ইউনিয়ন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সাধারণ শ্রমিক তো দূরে থাক, তাদের ইউনিয়নের একজনের হাতেও ৪ জুন ওসমানী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ প্রথমা জাতীয় চা দিবসের নিমন্ত্রণপত্র পৌঁছায়নি।
আমি নিমন্ত্রণ না পেয়েও গিয়েছিলাম ৪ জুনের অনুষ্ঠান দেখতে। শহরের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকদিন ধরে নানা ব্যানার-ফেস্টুন দেখে ওসমানী মিলনায়তনে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরি এ দিবস পালনের জন্য একটি কমিটিতে ছিলেন। তিনি জাতীয় চা দিবস পালনে জোর সমর্থন দিয়েছিলেন। জাতীয় দিবসের আগের দিন অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মনে তিনি ঢাকা থেকে নিজ এলাকা মৌলভীবাজার জেলা কমলগঞ্জে ফিরে যাচ্ছিলেন। কোনো নিমন্ত্রণ তার কাছে পৌঁছায়নি, তাই তিনি আর ঢাকায় থাকেননি। আরো একটি কারণে তার মন খুব খারাপ ছিল। জাতীয় চা দিবস নিয়ে বাংলাদেশ টি বোর্ড, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদ যখন আনন্দে আত্মহারা তখন ৩ জুন চা শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণের জন্য গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ড চা শ্রমিকদের নিম্নতম নগদ মজুরি চূড়ান্ত করে ১১৭-১২০ টাকায়। মজুরি বোর্ডে চা শ্রমিকদের প্রতিনিধি হিসেবে রামভজন কৈরি নগদ মজুরি দাবি করেছিলেন ৩০০ টাকা। আর মজুরি বোর্ড ২০১৯ ও ২০২০ সালের জন্য কার্যকর মজুরিই স্থির করে ২০২১ সালের ১৩ জুন। এতে রামভজন কৈরি ও চা বাগানের সব শ্রমিক ক্ষুব্দ হয়েছেন। মজুরি বোর্ড চা শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্য মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করেছে। একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নিম্নতম মজুরি ঠিকও হবে। কিন্তু ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত চা শ্রমিকদের মনে যে বেদনা তা যদি সরকার অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়, তবে বুঝতে হবে এ সরকার মানবিক বোধসম্পন্ন নয়।
নিয়োগ বৈষম্য, নারীর প্রতি সহিংসতা, অধিক হারে মাতৃমৃত্যু, অপুষ্টি, মানসম্পন্ন শিক্ষার সংকট, রোগবালাইয়ের আক্রমণসহ নানা সমস্যায় চা বাগানের মানুষ জর্জরিত। কিন্তু সব ছাপিয়ে যে বিষয়টি দৃশ্যমান তা হলো চা বাগানে শ্রম আইনের লঙ্ঘন, যা চা শ্রমিকদের নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শ্রম আইনে কিছু বৈষম্যও আছে।
প্রথমত চা শ্রমিকরা কেবল জাতীয় পর্যায়ে ইউনিয়ন করতে পারে। একটি বাগানে যত শ্রমিকই থাক না কেন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে তারা ইউনিয়ন করতে পারে না। একটি ইউনিয়ন করতে গেলে মোট শ্রমিকের ২০ শতাংশকে তার সদস্য হতে হবে। মালিক ও সরকার এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে যে শ্রমিকরা সবাই একটা ইউনিয়নের সদস্য হয়ে গেছে। তারা মাসিক চাঁদাও দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু তাদের অধিকাংশ ইউনিয়ন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পোষণ করেন না।
চা বাগানের কোনো শ্রমিকের হাতে ছবিসহ নিয়োগপত্র নেই। তারা অন্যান্য শিল্পের শ্রমিকদের মতো নৈমিত্তিক ছুটি পান না এবং অর্জিত ছুটি পান ২২ দিন কাজ করার জন্য একদিন, যা অন্যান্য শিল্পে শ্রমিকরা পান ১৮ দিন কাজ করার জন্য। অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ী শ্রমিকের সমান মজুরি পাওয়ার কথা থাকলে অধিকাংশ বাগানে তারা সেটা পান না। অন্যান্য অনেক সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত। নারী শ্রমিকরা যেখানে পাতা তোলেন সেখানে না আছে টয়লেট, না আছে প্রক্ষালন কক্ষ বা না আছে ছাউনি। নারী শ্রমিকদের খোলা জায়গায় বসে খেতে হয় এবং খোলা জায়গাতেই তারা মলমূত্র ত্যাগ করেন। শ্রম আইন অনুসারে কোম্পানির মুলাকার ৫ শতাংশ তারা কোনোদিন পাননি। অবসরে যাওয়া চা শ্রমিকরা নামমাত্র পেনশন পান (মাসে ৬০০ টাকা)। তারা গ্র্যাচুইটি পাননি কোনোদিন। তাদের আবাসন সাধারণত নিম্নমানের। আবাসন নিয়েও শ্রম আইন ও বিধিমালার লঙ্ঘন সুস্পষ্ট। চা শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা তাও সন্তোষজনক নয়।
চা শ্রমিকরা শুধু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীই নয়, ইতিহাস, পরিচয় ও পেশার কারণে তারা চরম অবহেলার শিকার। এদের বর্তমান অবস্থা থেকে টেনে তুলার জন্য নিয়োগদাতা, রাষ্ট্র ও বাঙালিদের বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। তাদের প্রাপ্য মর্যাদা, মজুরি ও শ্রম আইন ও বিধিমালা অনুসারে যেসব সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা তা দিতে হবে। এজন্য নিয়োগদাতা ও রাষ্ট্রের যেমন বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি চা শ্রমিকদের মর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক হওয়ার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরও জোর সমর্থন চাই।
ফিলিপ গাইন: গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (সেড) পরিচালক